যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হ’য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে…’
বাংলা সাহিত্যের অলংকার হয়ে ওঠা এই কবিতাটি লিখেছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের (বিএম কলেজ) ইংরেজির শিক্ষক, কবি জীবনানন্দ দাশ! তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। এই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীই বিষয়টি নিয়ে গর্ববোধ করতে পারেন।
বৃহত্তর দক্ষিণ অঞ্চল তথা বরিশালের অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন ( বিএম) কলেজ। যার রয়েছে যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস। কালের পরিক্রমায় প্রতিষ্ঠানটি আজও ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আছে। আছে স্কুল থেকে পর্যায়ক্রমে উচ্চ শিক্ষার নামী কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠার ইতিহাস।
সালটা ছিল ১৮৮৪; প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক মহাত্মা অশ্বিনী কুমার তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন স্কুল। অল্প সময়ের মধ্যেই স্কুলটির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তখনো প্রবেশিকা (মাধ্যমিক) পরীক্ষায় পাস করার পর বরিশালে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল না।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুরোধে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন বিএম স্কুল প্রাঙ্গণে যাত্রা শুরু হয় ব্রজমোহন কলেজের। কয়েক বছর পর কলেজটি স্থানান্তর করা হয়। অবিভক্ত ভারতের খ্যাতিমান শিক্ষকেরা এই কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল বিএম কলেজ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত থাকাকালীন এই কলেজের মান এতই উন্নত ছিল যে, অনেকে একে দক্ষিণ বাংলার অক্সফোর্ড বলে আখ্যায়িত করেন। সে সময় থেকেই এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সুনামের সাথে দক্ষিণাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার করে আসছে। ওই সময় প্রবেশিকা পরীক্ষায় সারা ভারত বর্ষে শতকরা ২২ ভাগের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেনি। কিন্তু বিএম ইন্সটিটিউট থেকে শতকরা ৮২ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করে। আর এতে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
স্বদেশী আন্দোলনের ফলে এই কলেজটি একটি বিপ্লবী চেতনা অর্জন করেছিল এবং ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এর আদর্শের স্রোত ঘটেছিল। অশ্বিনী কুমার স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে তার সঙ্গে সেই আন্দোলনে যুক্ত হন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ফলে ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে কলেজটি। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ এবং অন্যান্য ঘটনায় দুই তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী দেশ ত্যাগ করে। এ কারণে তৎকালীন পন্ডিত ব্রজেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, রাজোনিকান্ত গুহ, বাবু স্বাতীশ চন্দ্র যারা এ কলেজে গৌরব অর্জনের প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি তো জড়িয়ে আছেই, এ ছাড়া বহু গুণীজন এই কলেজে পা রেখেছেন। অনেকবার ব্রজমোহন কলেজ ক্যাম্পাসে এসেছেন বাংলার বাঘখ্যাত শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী এই কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য কিংবদন্তি শিক্ষক যেমন অধ্যাপক মো. হানিফ, কাজী গোলাম কাদের, অধ্যাপক শামসুল হক, ড. প্রানোতি বোস এই কলেজের সঙ্গে বিজয়ী হয়েছেন। যথাযথ শিক্ষা দেওয়ার কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ কলেজটিকে ১৯২২ সালে প্রথমে ইংরেজী ও দর্শনশাস্ত্রে এবং পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য শাখায় অনার্স কোর্স করার অনুমতি দিয়েছিল।
১৯২২-১৯৪৮ সময়টি ছিল বিএম কলেজের জন্য স্বর্ণযুগ। এ সাফল্য এমনকি স্যার উডবার্ন এবং অন্যান্য ইংরেজ উচ্চ আধিকারিকদের মন্তব্যও এনেছিল যে কলেজটিকে অক্সফোর্ডের সাথে স্থান দেওয়া উচিত। কিন্তু ১৯৪৭ সালে বিভাজন এ কলেজের জন্য এক ধাক্কা ছিল। সুতরাং অনার্স কোর্স বন্ধ ছিল। ১৯৬৪-৬৫ সালে বি.এম. কলেজে আবারও অনার্স কোর্স চালু হয়।
এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানুষের মতো মানুষ গড়ার কারিগর। সাহিত্যিক মিহির সেনগুপ্ত, ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নজরুল ইসলাম মঞ্জু, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, কবি আসাদ চৌধুরী, সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অনেক গুণী ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন।
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এ কলেজটিতে ২২টি বিষয়ে অনার্স ও ২১ টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। এ কলেজে বর্তমানে ১৮৫ জন দক্ষ ও বিচক্ষণ শিক্ষক মন্ডলী রয়েছেন। যারা কলেজের প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাচ্ছেন।
ব্রজমোহন কলেজ কেবল বাংলাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি পুরো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অহংকারও। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রেখেছেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এখনো সেই সম্পর্কটা আছে।