তাজহাট জমিদার বাড়ি : যার পরতে পরতে ইতিহাসের ছোঁয়া
ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি একটি জাতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় বহন করে থাকে। শুধুমাত্র পরিচয় বহনেই সীমাবদ্ধ থাকে না এদের পরিধি। জাতিকে তার নিজস্ব সত্ত্বায় বাঁচতে উৎসাহিত করা এবং মাটি ও মানুষের সঙ্গে আত্মার মিলনের আহবানেও ভূমিকা রাখে এই ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এদের পরিপূর্ণতার মাধ্যমেই বিশ্ব দরবারে একটি জাতির সমৃদ্ধি প্রকাশ পেয়ে থাকে।
একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। জানতে হবে ইতিহাসের গভীরে লুকিয়ে থাকা জানা-অজানা সব গল্পগুলো। আজ আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের সেরকমই একটি গল্প শোনাবো আপনাদের, যে গল্পের পটভূমি রচিত হয়েছিল বৃহত্তর রংপুর জেলার তাজহাট জমিদার বাড়ির পরতে পরতে।
তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মান্নালাল রায়। শিখ থেকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া মান্নালাল রায় পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার। কথিত আছে, তিনি পাঞ্জাব থেকে এদেশে আসেন এবং তৎকালীন রংপুরের জেলা সদর মাহীগঞ্জে তার বসতি স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে এখানে মান্নালাল রায়ের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে এবং একসময় তিনি আশেপাশের একটি বিস্তৃত অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হোন।
মান্নালাল রায়ের মত আরো একজন ছিলেন; যিনি পাঞ্জাব থেকে এদেশে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। তার নাম রতন লাল রায়। একসময় মান্নালাল রায়ের নাতি ধনপত রায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় রতন লাল রায়ের নাতনীর।
ধনপত রায়ের নাতি ছিলেন উপেন্দ্রলাল রায়। অল্প বয়সে উপেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যু হলে জমিদারের স্থানে অভিষিক্ত হোন তার কাকা গিরিধারি লাল রায়। কিন্তু গিরিধারি লালের কোন সন্তান ছিল না। তাই পরবর্তী জমিদারির কথা চিন্তা করে তিনি গোবিন্দ দাসকে দত্তক হিসবে গ্রহণ করেন। গিরিধারি লালের পর ১৮৭৯ সালে এই গোবিন্দ দাসই জমিদারের আসনে আসীন হোন। গোবিন্দ দাসের স্বাধীনচেতা মনোভাব খুব সহজেই তাকে অন্যদের কাছে জনপ্রিয় জমিদারে পরিণত করতে সক্ষম হয়। ফলস্বরুপ তিনি ১৮৮৫ সালে ‘রাজা’ এবং ১৮৯৬ সালে ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হোন। কিন্তু ‘মহারাজা’ হওয়ার মাত্র এক বছরের মাথায় ঘটে যায় এক দুর্ঘটনা। ভূমিকম্পে গোবিন্দ দাসের বাড়ি পরিণত হয় এক ধ্বংসস্তূপে আর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন জনপ্রিয় এই রাজা। এরপর কেটে যায় অনেক কয়টি বছর। অবশেষে ১৯০৮ সালে জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন মহারাজা কুমার গোপাল রায়।
মহারাজা কুমার গোপাল রায়ও ছিলেন মান্নালাল রায়ের মত একজন স্বর্ণকার। লোকমুখে শোনা যায়, গোপাল রায়ের চমৎকার মুকুট বা তাজের কারণেই এই এলাকার নাম হয়ে যায় তাজহাট। তাজহাট জমিদার বাড়ি বলে আমরা যে প্রাসাদটিকে চিনি, তা বিংশ শতাব্দীতে গোপাল রায়ের হাতেই নির্মিত হয়। ৭৬.২০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এই দোতলা প্রাসাদটি হল পূর্বমুখী। এর সম্মুখভাগে রয়েছে অত্যন্ত প্রশস্ত একটি সিঁড়ি, যা তৈরি করা হয়েছে বিদেশ থেকে আনা সাদা রঙের মার্বেল পাথর দিয়ে। সিঁড়ির প্রধান আকর্ষণ হিসেবে এর দুইপাশে রোমান দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। যদিও বা পরবর্তীতে আর সেগুলোর খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রাসাদে সর্বমোট ২২টা কক্ষ রয়েছে। উপরতলায় উঠার জন্য রয়েছে কাঠের তৈরি দুটি সিঁড়ি। এছাড়া প্রাসাদের পুরোটা অংশ জুড়েই রয়েছে প্রশস্থ বারান্দা, যার প্রস্থ ৩ মিটার।
তাজহাট জমিদার বাড়ি সবার কাছে জাদুঘর হিসেবে পরিচিত হলেও এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় ছিল। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্জ হিসেবে ভবনটির যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৪ সালে। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এটিকে এই কাজেই ব্যবহার করা হয়। এখনো যদি আপনি এখানে ঘুরতে যান, তাহলে প্রাসাদের একপাশে সুপ্রীম কোর্টের মাঝারি আকারের একটি সাইনবোর্ড দেখতে পারবেন।
এরপর ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রাসাদটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০৫ সালে ‘রংপুর জাদুঘর’ হিসেবে এর নতুন যাত্রা শুরু হয়।
রংপুর শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ষোল একর জমির উপর বিস্তৃত এই জাদুঘর। প্রতিদিন এখানে ভীড় জমান শত শত দর্শনার্থী। কেউ বা আসেন শহুরে যান্ত্রিকতা থেকে পালিয়ে এখানকার নয়নাভিরাম পরিবেশে নিরিবিলি সময় কাটাতে আর কেউ বা আসেন আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের জ্ঞান ও গন্ধের খোঁজে।
—মেহেদী হাসান গালিব