ঢাকা কলেজ: ইতিহাস ও বর্তমান
ঢাকা কলেজ উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। গবেষণার ভিত্তিতে ইতিহাসবিদগণ ১৮৪১ সালের ১৮ জুলাই রোববার শুভদিনে ঢাকা কলেজের যাত্রাকাল হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও অনেকের মতে ১৮৪১ সালের জুলাই ৭ এবং আগস্ট ১১ এর মধ্যবর্তী কোনো একটি তারিখে বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- ঢাকা কলেজ স্থাপিত হয়।
ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার সঠিক তারিখ সম্পর্কিত অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হলো, কলেজ প্রতিষ্ঠার সঠিক দিন বা তারিখ কোনো গ্রন্থে বা অন্য কোথাও উল্লেখ নেই। সুনির্দিষ্টভাবে শুধু ১৮৪১ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠার সন পাওয়া যায়। তবে পরবর্তীতে গবেষণার ভিত্তিতে ইতিহাসবিদগণ ১৮৪১ সালের ১৮ জুলাইকে ঢাকা কলেজের যাত্রাকাল হিসেবে উল্লেখ করেন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং প্রকৃতপক্ষেই তারা এ অঞ্চলের শাসকে পরিণত হয়। ইংরেজরা এসময় নিজেদের শাসক হিসেবে পরিচয় না দিলেও ১৭৭২ সালে গর্ভনর ওয়ারেন হেস্টিংস এ মুখোশ খুলে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে সরাসরি এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এরপর পরবর্তী ৬২ বছর পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসকগণ তাদের রাজত্বের অধিবাসীদের জন্য কোনো শিক্ষানীতি প্রনয়ণ বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ দীর্ঘ সময়ে এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবেই চলছিলো। অবশেষে ১৮৩০ এর দশকে সরকার এক শিক্ষানীতি গ্রহণ করে এবং সে নীতিমালায় যে শিক্ষানীতির প্রচলন হয়, তা মূলত পাশ্চাত্য বা ইংরেজি শিক্ষা নামে পরিচিতি পায়।
এ আধুনিক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের জন্য সেসময়ে ঢাকাতে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠলেও- শিক্ষা প্রসারের চেয়ে, ধর্ম প্রচার সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে উল্লখ করার মতো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেখানে গড়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে, ১৮৩৫ সালের ২০ এপ্রিল সে সময় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) লর্ড বেন্টিকের নিকট একটি প্রতিবেদন পেশ করে, যেখানে বলা হয়, সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতোগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক।
পরবর্তীকালে এ প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকার কর্মকর্তাদের নিকট এ সংক্রান্ত চিঠি প্রদান করা হলে ঢাকার সে সময়ের সিভিল সার্জন ডা: জেমস টেইলার (Dr. James Tailer) জানান যে, এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যে কেবল উচিতই নয়; বরং এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকারের সুবিধা (আর্থিক এবং সামাজিক) পাওয়া যাবে। মূলত তখন থেকেই শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু হয় ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।
এ আধুনিক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের জন্য সেসময়ে ঢাকাতে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠলেও- শিক্ষা প্রসারের চেয়ে, ধর্ম প্রচার সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে উল্লখ করার মতো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেখানে গড়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে, ১৮৩৫ সালের ২০ এপ্রিল সে সময় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) লর্ড বেন্টিকের নিকট একটি প্রতিবেদন পেশ করে, যেখানে বলা হয়, সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতোগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক।
পরবর্তীকালে এ প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকার কর্মকর্তাদের নিকট এ সংক্রান্ত চিঠি প্রদান করা হলে ঢাকার সে সময়ের সিভিল সার্জন ডা: জেমস টেইলার (Dr. James Tailer) জানান যে, এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যে কেবল উচিতই নয়; বরং এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকারের সুবিধা (আর্থিক এবং সামাজিক) পাওয়া যাবে। মূলত তখন থেকেই শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু হয় ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।
এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতে একদিকে যেমন বদলে যেতে থাকে সমাজের সামগ্রিক চালচিত্র, তেমনি বিদ্যার্থীদের মানসসম্মুখে পাশ্চাত্যের কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং দর্শনকে উন্মোচিতো করে। শিক্ষা এবং সমাজ ব্যবস্থার এ ইতিবাচক পরিবর্তনে সে সময়ের গর্ভনর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) কতোগুলো কেন্দ্রীয় কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। এর প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত ব্যায়ের কথা উল্লেখ এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা তার যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে ১৮৪১ সালে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়, যার নাম দেয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলের নাম দেওয়া হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল।
বলাবাহুল্য, এ কলেজ প্রতিষ্টার পর পরই বদলে যায় সমগ্র ঢাকার চালচিত্র। ঢাকা হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ববাংলার ইংরেজি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। প্রথম ঢাকা কলেজ ভবন কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয়। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে ঢাকা কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত ব্যাবস্থাপনার ভিত্তি। সে অর্থে আয়ারল্যান্ডই ঢাকা কলেজের সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক।
তিনি কলেজের শিক্ষাদান ব্যবস্থাপনায় আনেন বৈপ্রবিক পরিবর্তন। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রম-বিকাশ ও ঢাকা কলেজ ১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা আধুনিক বাংলার ইতিহাসে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তেমনি ঢাকা কলেজের জন্যও এক অভাবনীয় ঘটনা। কেননা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পরই ঢাকা কলেজকে এর অধিভুক্ত করা হয়। সে সময় থেকেই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণ করে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলে ও এর কাঠামোগত বা অন্য পরিবর্তনসমূহের কথা ভাবা হয়নি গুরুত্বের সঙ্গে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, সে সময়ের সরকার মূলত কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে এর একটি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। এমনকি এ কলেজে কোনো নতুন অধ্যাপকও নিয়োগ দেয়া হয়নি। ১৮৫৬ সালে গণিতশাস্ত্রের পন্ডিত অধ্যাপক ব্রেনান্ডকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয়। ব্রেনান্ড নিয়োগ পাবপর সঙ্গে সঙ্গে কলেজের উন্নতিকল্পে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করে। বলাবাহুল্য, ব্রেনান্ডকে পেয়ে ঢাকা কলেজ এক ক্রান্তিলগ্ন থেকে ঘুরে দাড়াতে সক্ষম হয়।
ঢাকা কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা আবারো হোচট খায় ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময়। শহরের ইউরোপীয় কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার, এমনকি ঢাকা কলেজের ইউরোপীয় শিক্ষকরাও এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি। এ সশস্ত্র বিপ্লব কোম্পানীর অর্থনৈতিক ভিত্তিকে একেবারে ভেঙ্গে ফেলে এবং ভারত সরকারকে বহুকাল যাবত আর্থিক সংকটে রাখে। ফলে সরকারের তরফ থেকে ঢাকা কলেজের শিক্ষাথাতে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থব্যায়ের ইচ্ছা বা সাধ্য কোনোটাই ছিলো না। এসবের ভেতরেও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রথম বছরেই (১৮৫৮ সালে) ৪ জন ছাত্র প্রথম বারের মতো স্নাতক বা বি.এ পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কোলকাতা পাড়ি দেয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, সেমসয় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিলো একমাত্র পরীক্ষা কেন্দ্র। সিপাহী বিদ্রোহের অবসানের পর দেমের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে বা অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছল হতে বেশ সময় লাগে। একারণে ঢাকা কলেজের অবস্থা ক্রমাবনতির দিকেই যেতে থাকে। কলেজ ভবনটিও সামরিক বাহীনির অধীনে চলে যায়। যে বাড়ি দুইটিতে কলেজের কার্যাবলি সাময়িকভাবে পরিচালিত হচ্ছিলো, তাও ছিলো বেশ অনুপযোগী। এতদসত্ত্বেও কলেজের ছাত্রসংখ্যা বেড়ে ১৮৫৯-৬০ সালে ৫১ জন হয়; এদের মধ্যে ২ জন খ্রিস্টান, ১ জন মুসলমান এবং ৪৮ জন ছিলো হিন্দু।
পূর্ববঙ্গের স্কুল-কলেজ পরিদর্শক তার ১৮৫৯-৬০ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে ঢাকা কলেজে যে কোর্স পড়ানো হয়, তা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ পরীক্ষার কোর্সের সমতুল্য এবং কোর্স সমাপনে ছাত্রদেরকে জ্ঞানের পাচটি শাখায় পরীক্ষা দিতে হয়। এ পাচটি বিষয় ছিলো যথাক্রমে ইংরজি সহ দুটি ভাষা, ইতিহাস এবং ভূগোল, অঙ্ক, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা) এবং মানসিক নৈতিক বিজ্ঞানে। এসকল বিষয়ে পঠনের মান ছিলো অত্যন্ত উচু এবং ছাত্রদেরকে এ উচ্চ মানই অর্জন করতে হতো। এগুলোর কোনো একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হলে অন্য সকল বিষয়ে অসাধারণ ভালো ফল করলেও ছাত্ররা কৃতকার্য হতে পারতো না।
পরবর্তীকালে সরকার ঢাকা কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়। প্রথমত, ১৮৬০ সালে দেশে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষার নিয়ম কানুনে কিছু রদবদল করা হলে স্কলারশিপ প্রাপ্ত ছাত্র সংখ্যা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, দেশে নতুন নতুন জেলা স্কুল এবং ইঙ্গ-বাংলা স্কুল থেকে ঠিক এসময়ই বেশি সংখ্যক ছাত্র এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করে যারা বৃত্তি নিয়ে ঢাকা কলেজে পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ঢাকা কলেজের ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির একটি সুন্দর পরিসংখ্যান পাওয়া যায় সেসময়ের পূর্ববাংলার ডিপিআই এটকিনসনের লেখা একটি চিঠি থেকে ১৮৭৫ সালে ঢাকা কলেজ একটি বড়ো সম্মান লাভ করে। সে বছর থেকে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান ক্লাশ খোলা হয়, অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন নতুন বিষয় পড়ানোর সিধান্ত গৃহীত হয়।
এটা ছিলো একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন কেননা, এর মাধ্যমে পূর্ববাংলার তরুণদের মধ্যে আধুনিক যুগের হাতিয়ার, বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হবে। বিজ্ঞান ক্লাশগুলো খোলার পর ঢাকা কলেজে ছাত্র ভর্তির হিড়িক পড়ে যায়। একই সঙ্গে এ কলেজের অবকাঠামোগত পরিবর্তনও হয়। এরপরও নানা ঘাতপ্রতিঘাত থাকলেও, এ ঢাকা কলেজ শিক্ষাক্ষেত্রে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছিলো, যার সোনালী ফসল ছিলো ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি। কলেজ ভবন উনিশ শতকে ঢাকা নগরের ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে অনেক আশা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সরকারি উদ্যোগ এবং জনগণের উৎসাহ ও সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজ ভবনটির ও রয়েছে এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস।
শুরুতে কলেজটি পূর্বের স্থাপিত ঢাকা গর্ভনমেন্ট স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত করে গড়ে তোলা হলেও অতি শিগগিরই এটির জন্য একটি পৃথক ভবন প্রয়োজন হয়। ঢাকা কলেজ ভবনের নিচতলার নকশা তবে এ বিষয়ে সরকারের খুব একটা সদিচ্ছা ছিলো না। কলেজ ভবন নির্মাণের জন্য সরকার স্থানীয়ভাবে একটি কমিটি গঠন করে। তবে কলেজ ভবন তৈরি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াবলীর দায়িত্ব তদারকি করে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন। ভবনটির নকশা তৈরি এবং নির্মানের দায়িত্ব পায় মিলিটারি বোর্ড। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার তৎকালীন বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজ হিসেবে এর ভিত্তি স্থাপন করেন । প্রতিষ্ঠালগ্নে ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বুড়িগঙ্গার তীরে । সদরঘাটের স্থপতি কর্নেল গ্যাসর্টিন এর নকশা করেন। খাটি ব্রিটিশ ঢঙে, বিলাতি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আদলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়।
অনুষ্ঠান উপলক্ষে রেভারেন্ড ড্যানিয়েল একটি যথাযথ এবং প্রাসঙ্গিক বক্তৃতা প্রদান করেন। ঢাকা কলেজ ভবনের সম্মুখভাগের নকশা ছাত্রহল এবং এর ইতিহাস ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠা একদিকে যেমন নাগরিক জীবনে যোগ করেছিলো অভিনব সামাজিক বৈশিষ্ট্য, তেমনি ছাত্র সমাজের জন্যও এক ভিন্নমুখী জীবনযাত্রার সূচনা করেছিলো। ছাত্রদের বিচিত্র জীবন যাপনের ধারা থেকে যেমন ঢাকা শহরএ উৎপত্তি হয় এক নতুন ধারার সংস্কৃতির, এক নতুন সামাজিক বাতাবরণের। তদুপরি ঢাকার বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের জীবনে যোগ হচ্ছিল নতুন ধরনের চমক।
বাইরে থেকে ঢাকা কলেজে পড়তে আসা ছাত্রদের তথ্য প্রথম পাওয়া যায় ১৮৪৩ সালে। সে বছর কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায় যে, ১৫ জন ছাত্র বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। এদর মধ্যে ৭ জন ফরিদপুর, ২ জন বরিশাল, ২ জন যশোহর, ২ জন ময়মনসিংহ এবং এমনকি ২ জন উত্তর প্রদেশ থেকেও এসেছে। তবে তা সত্ত্বেও ঢাকা কলেজের বহিরাগত ছাত্রদের জন্য কোনো ধরনের ছাত্রাবাস ১৮৮০ সাল পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। এ দীর্ঘ সময়ে ছাত্ররা তাই নানাবিধ কষ্টের মধ্যেই তাদের জীবন অতিবাহিত করে। যদিও ১৮৭৪ সালে ঢাকায় একটি ছাত্রাবাস স্থাপিত হয়, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তারপর নানা সময়ে ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাস স্থাপনে নানা সমস্যা দেখা দেয়। কখনো সরকারি বিধি নিষেধের বলয়, আবার কখনো সামাজিক নানা সমস্যার কারণে ছাত্রাবাস গড়ে ওঠেনি।
সবশেষে বাংরা সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে ১৮৮০ সালে ঢাকা কলেজের জন্য বাংলাবাজারের শ্রীদাস লেনে রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল নামে প্রথম ছাত্রাবাস নির্মিত হয়। সেসময়ের অধ্যক্ষ এ হোস্টেল স্থাপনাকে সে বছরের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা বলে উল্লেখ করেছিলেন। হোস্টেলের ছাত্র সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ১৮৮৩-৮৪ সালে বোর্ডারের সংখ্যা ৯০ জনে এসে দাড়ায়। একঅর্থে এ বৃদ্ধি হোস্টেলের সমৃদ্ধি এবং ছাত্রদের সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশে বাস করার আগ্রহ বৃদ্ধির ইঙ্গিত করলেও কর্তৃপক্ষের জন্য হয়ে উঠে বড়ো এক বিড়ম্বনা। কেননা এতো অধিক ছাত্রের জন্য ভবনটি যথেষ্ট ছিলো না।
পরবর্তীতে ১৯০৪ সালের ২৭ মে এক সরকারি সভায় ঢাকা কলেজের জন্য একটি আধুনিক ছাত্রাবাস নির্মাণের সিধান্ত গৃহীত হয়। সে সময়ের অন্যতম স্থাপত্যবিদ্ পি. ডব্লিউ. ডি কর্তৃক একটি নকশা পেশ করা হয়। বলা বাহুল্য, এ নকশাটিই ছিলো বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক ধারার ছাত্রাবাস নির্মাণের নকশা। তিনি ঘরগুলোকে ২০X১৪ ফুট আয়াতাকার ভাবে তৈরি করার প্রস্তাব দেন। তিনি প্রতিঘরে ৪ জন করে থাকতে পারবে বলে মতামত প্রকাশ করেন। পি.ডব্লিউ.ডি কর্তৃক পেশকৃত ঢাকা কলেজের প্রথম আধুনিক ছাত্রাবাসের নকশা পরবর্তীতে সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং এ নতুন দুটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে বহু ছাত্র উপকৃত হয়। হোস্টেলের নামকরণ করা হয় সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল। এ হলের ডাইনিং রুমটি ছিলো বিরাটাকার।
১৯১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এখানেই বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের একাদশ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজের হিন্দু হোস্টেল রূপান্তরিত হয় ঢাকা হলে (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) এবং সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং এর মুসলিম হোস্টেলটি হয়ে যায় মুসলিম হল (বর্তমান সলিমুল্লাহ মুসলিম হল)। ১৯০৮ সালে ঢাকা কলেজের জন্য পরিকল্পিতভাবে নির্মিত প্রথম ছাত্রাবাস। উল্লেখ্য যে এটি বাংলাদেশের কোনো সরকারি কলেজের জন্য নির্মিত প্রথম ছাত্রাবাস। বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল।
বর্তমানে ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এবং শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাঙ্গন। এর ছাত্রসংখ্যা প্রায় ২২ হাজার। এখানে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমের সাথে সাথে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১৯টি বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু রয়েছে । ছাত্রদের জন্য ঢাকা কলেজে ৮টি ছাত্রাবাস রয়েছে । এসব ছাত্রাবাসে ছাত্রদের আধুনিক এবং উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করে থাকে। আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়ের অধীনে থাকলেও, বর্তমানে কলেজটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে।