যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহেও ব্যবহার হতো রাণী ভবানীর টমটম
ঘড়ির কাটা তখন সবে ১২টার ঘর পেরিয়েছে। সূর্যের প্রখর তাপে নারিকেল গাছের তলায় বসে দর্শনার্থীদের জন্য অপেক্ষা করছিল একটি টমটম। খানিকক্ষণ পর এসে দাঁড়ালো আরেকটি। দুটি টমটমেরই চেহারার দশা বেহাল। অথচ একটা সময়ে এই টমটমগুলোই বাংলার পথেঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছে রাজা-রাণী ও জমিদারদের নিয়ে। বর্তমানে এই টমটমগুলো বহন করে চলেছে প্রাচীন বাংলার অসংখ্য রাজকীয় ইতিহাস। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হল, সেই সময়কার সাক্ষী হয়ে থাকা এই টমটমগুলো যেন বিলুপ্তির পথে।
কথা হল টমটম চালক রহেদ আলী পরামানিকের সঙ্গে। স্বাধীনতার পর থেকেই এই পেশায় জড়িত এই বৃদ্ধ। তখন তার বয়স হবে চৌদ্দ কী পনেরো। বাবা, আসাদ আলী পরামানিকের হাত ধরেই টমটম চালানোয় হাতেখড়ি। এরপর আর নিজেকে জড়ানো হয়নি অন্য পেশায়। দীর্ঘ সময় ধরে এই পেশায় কাজ করে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন এক মায়ার বন্ধনে। হয়তো বা তাই অভিমানের পাল্লাটাও খানিকটা ভারি। অভিমানের সুরে রহেদ আলী জানান, ‘এইতো কয়েক দশক আগের কথা। তখন এই শহরে টমটম ছিল প্রায় সাড়ে তিনশ। অথচ এখন পুরো শহরে টমটম মাত্র চারটা।’
আগেরকার সময়ে রাজা-রাণী ও জমিদারদের শৌখিন ভ্রমণসহ যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো এই টমটমকে। শুধু কী তাই?-যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহের যান হিসেবেও ব্যবহৃত হতো এই টমটম। কিন্তু গতিময় যান্ত্রিক জীবনের কাছে হেরে গিয়েছে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই যান। এখন শহরের রাস্তাঘাটে এসবের দেখা মেলা ভার। নাটোরের মূল শহরের রাস্তায় এসব টমটম খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। চারটি টমটমই অবস্থান করে রাণী ভবানী রাজবাড়ীতে। দশ টাকার বিনিময়ে রাজবাড়ির ১২০ একর জায়গা ঘুরে বেড়িয়ে দেখান দর্শনার্থীদের। সঙ্গে বর্ণনা করে যান প্রতিটি অংশের ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব। তবে অনেক দর্শনার্থী শখের বসে টমটমে চড়ে উত্তরা গণভবন কিংবা শহর ঘুরতে চাইলে রাজবাড়ির বাইরেও টমটম নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন রহেদ আলী।
রহেদ আলীর ঘোড়াটির নাম সম্রাট। প্রতিদিন সকাল দশটায় রহেদ আলী তার সম্রাট ও টমটম নিয়ে চলে আসেন রাজবাড়িতে। থাকেন বিকাল পাঁচটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত। দর্শনার্থীদের ঘুরিয়ে দিনে রোজগার করেন পাঁচশ থেকে সাতাশ টাকা।তবে রোজগারের এই পরিমাণ নির্ভর করে দর্শনার্থীদের সংখ্যার ওপর। আগের তুলনায় এখনকার দর্শনার্থীদের কথা জানতে চাইলে রহেদ আলী জানান, ‘দর্শনার্থীদের সংখ্যা আগের তুলনায় এখন অনেকটাই কম।’
যান্ত্রিক জীবন ও দৈনন্দিন ব্যস্ততার কারণে দর্শনার্থীদের সংখ্যা দিনদিন কমে গেলেও বাঙালি মন থেকে হারিয়ে যায়নি টমটমের আবেদন। এখনো রাজবাড়িতে ঘুরতে আসা অধিকাংশ দর্শনার্থী এই টমটমে চড়ে ঘুরে দেখেন পুরো রাজবাড়ি। কখনো বা আবার ঘুরে দেখেন শহর।
স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে রহেদ আলীর সংসার। তিনি বসবাস করেন নাটোরের মূল শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরের গোবিন্দপুর ঘাট গ্রামে। জীবনের বাকি সময়টা সম্রাট ও তার টমটম নিয়েই কাটাতে চান ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ। তবে তিনি মনে করেন, টমটমের প্রাচীন জৌলুস আবার ফিরিয়ে আনা দরকার। বাঙালির প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা এই যানটি যেনো আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত না হয়ে, সেই কামনাই করেন রহেদ আলী।
—মেহেদী হাসান গালিব