কথা বলে মন জয় করার উপায়
কথা বলা ও সুন্দরভাবে কথা বলা—দুটি বিষয় খুবই আলাদা। কথা এমন একটি অদৃশ্য হাতিয়ার; যেটির মাধ্যমে আপনি যে কারও মন জয় করে নিতে পারেন। কারণ আপনার কথায় কেউ মুগ্ধ হলে, তার মন জয় হবেই!
বর্তমান বিশ্বে স্মার্টনেসের প্রথম শর্ত সুন্দর কথা। কথা ইংরেজিতে বলতে হবে এমন নয়; সঠিক ও সুন্দরভাবে বাংলা বলতে পারাটাও বড় গুণ। অনেকেই দেখা যায় অনেক জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও উপস্থাপনের ঘাটতি থাকায় কেউ তাতে আগ্রহ দেখায় না। নিজেকে প্রকাশ করতে কে না চায়? সবাই চায় নিজেকে সবচেয়ে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে। বাহ্যিক সৌন্দর্যের মধ্যে ভাব প্রকাশের সৌন্দর্য হচ্ছে অন্যতম একটি উপাদান। আর এজন্যই প্রয়োজন স্মার্টভাবে কথা বলার উপায় জানা।
কথা বলা কিন্তু একটি শিল্পও বটে। সাবলীল কথা বলার গুণ চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহকারী অধ্যাপক ও বিজনেস কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ সাইফ নোমান খান জানালেন কীভাবে সাবলীলভাবে কথা বলার চর্চা করবেন—
১. হাসিমুখে কথা বলা শিখুন আর শরীরী ভাষার দিকে নজর দিন
হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করুন। কথা বলার সময় হাত কোথায় রাখছেন, ঘাড় কতটুকু বাঁকাচ্ছেন কিংবা ভ্রু কতটুকু ব্যবহার করছেন—সবটাই খেয়াল রাখুন। চোখে চোখ রেখে কথা বলা শিখুন। যার সঙ্গে কথা বলছেন, তার দিকে না তাকিয়ে কথা বলা অসম্মান ও অভদ্রতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত দেড় মাস চেষ্টা করুন; আপনি পারবেন!
২. আঞ্চলিকতা পরিহারের চেষ্টা করুন
আঞ্চলিকতার টান পরিহার করা শিখুন। টানা ছয়-সাত সপ্তাহ সময় দিলে আঞ্চলিক টান কথায় কমিয়ে আনতে পারবেন। শুরুতে হয়তো সমস্যা হবে, কিন্তু আঞ্চলিকতা অবশ্যই পরিহার করা যায়। ইংরেজিতে কথা বলার সময় পরিষ্কারভাবে ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান উচ্চারণ অনুসরণ করুন। কথার মধ্যে কখন, কীভাবে, কতটুকু বিরতি নিতে হয়, তা নিজেই উপলব্ধি করুন।
৩. বুঝে কথা বলুন, শ্রোতাকেও বুঝুন
প্রথমে ভালোভাবে শুনতে হবে। এরপর বুঝতে হবে। তারপর সমন্বর করুন; আপনি কী বলবেন, কীভাবে বলবেন। প্রয়োজনে টুকরো কাগজে লিখে নিন। আপনি যার সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি কথা বুঝতে পারছেন কি না, সেদিকে মনোযোগ দিন। আপনি কী বলছেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার শ্রোতা কী শুনছেন বা তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পারছেন কি-না। তবে, আপনার কথায় আত্মবিশ্বাস থাকা সবচেয়ে জরুরি।
৪. বক্তৃতার ক্ষেত্রে কৌশলী হোন
অনেক মানুষের সামনে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় আপনাকে খুবই কৌশলী হতে হবে। শ্রোতাদের চোখে তাকান। তাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে আপনার স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন করতে হতে পারে, সে জন্য তৈরি থাকুন। খুব দ্রুত কথা বলছেন কি না, সেটা বুঝতে হলে আগে নিজেই নিজের কথা মুঠোফোনে রেকর্ড করুন। বারবার অনুশীলন করুন।
কথা বলার সময় অবশ্যই বক্তব্য গুছিয়ে নেবেন। অন্তত একটা ছক তৈরি করে নিন। প্রথম মিনিটে কী বলবেন, দ্বিতীয় মিনিটে কী আলোচনা করবেন আর বক্তব্য শেষ করবেন কীভাবে—সাজিয়ে নিন।
৫. জটিল বাক্য ও নেতিবাচক কথা পরিহার করুন
কম শব্দে খুব বেশি কাজের কথা বলার চেষ্টা করুন। কথা বলার সময় জটিল বাক্য ব্যবহার করবেন না। শব্দভান্ডার কিংবা বিদ্যার দৌড় কখনোই কথার মধ্যে প্রকাশের চেষ্টা করবেন না। সরল ও সাধারণ শব্দ ও বাক্যে কথা বলার চেষ্টা করুন। সমালোচনা করতে হলে যৌক্তিকভাবে করুন। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিন।
৬. সমস্যা নয়, সমাধান বলুন
ধরুন, আপনি একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে লিফটে উঠেছেন। ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য তার সঙ্গে নিরিবিলিতে কথা বলার সুযোগ আপনি পাচ্ছেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে তার সামনে কোনো ‘আইডিয়া’ উপস্থাপন করবেন? ২০-৩০ সেকেন্ডের মধ্যে কার্যকরভাবে একটা ভাবনা উপস্থাপন করাকে বলা হয় ‘এলিভেটর পিচ’। এসব ক্ষেত্রে সমস্যা নয়, সমাধান বলুন। শ্রোতার আগ্রহের জায়গা সম্পর্কে আগে জেনে নিন, সেভাবেই আপনার বক্তব্য তৈরি করুন। ‘আরেকটু সময় পেলে বোঝাতে পারতাম,’ এই মনোভাব রাখবেন না।
৭. অন্যকে অনুসরণ করুন, শিখুন
সুন্দর করে কথা বলার শিল্প রপ্ত করতে টেড–এর বিভিন্ন ভিডিওসহ হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ কিংবা ব্লুমবার্গ বিজনেস ম্যাগাজিনের বিভিন্ন ভিডিও দেখুন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লাইভ ভিডিও লেকচার দিয়ে থাকেন, সেগুলো দেখুন। ভিডিও থেকে তাদের মতো করে কথা বলা, বাক্য ব্যবহার আর শব্দ প্রয়োগ আয়ত্ত করুন। আপনি পেশাজীবনে যাঁর মতো হতে চান, তাঁকে অনুসরণ করতে পারেন।
৮. বলতে হলে পড়তে হবে
যাঁরা সুন্দর করে কথা বলেন, তারা কিন্তু ব্যক্তিজীবনে অনেক পড়াশোনা করেন। পড়ার বিকল্প নেই। ফিকশন, নন-ফিকশন—সব ধরনের বই পড়ুন। নানা ধরনের বই পড়লে নিজের মধ্যে নানা বিষয়ে জ্ঞান ও তথ্য জমা হয়, তাই কথা বলার সময় গুছিয়ে বলে ফেলার শিল্প রপ্ত করা সহজ হয়। যেকোনো মিটিং কিংবা পাবলিক স্পিকিংয়ের ক্ষেত্রে কথা শুরুর আগে শ্রোতা কিংবা যার সঙ্গে কথা বলছেন, তার বা তাদের অনুমতি নিয়ে শুরু করুন। শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখার জন্য সঠিক তথ্য ব্যবহার করে কথা বলুন। খেয়াল রাখবেন, শ্রোতা যা জানেন, তার পুনরাবৃত্তি করা ঠিক নয়।
৯. চর্চাই সব
হুট করে সুন্দর কথা বলার শিল্প আয়ত্তে আসে না। নিজেকে বদলাতে চার থেকে পাঁচ মাস সময় দিন। এই বিনিয়োগ কিন্তু আজীবন কাজে আসবে। শেখার সময় ভুল হবেই, তা-ও শিখতে থাকুন। বাড়ির বড়দের কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে আপনার যত ভুল, তা জেনে নিন। মানুষের কটাক্ষে মন খারাপ না করে ভুল সংশোধনে মনোযোগ দিন। স্পষ্ট করে কথা বলুন।
১০. অনলাইনে কোর্স করুন
কোর্সেরা, ইউডেমি, ফিউচার লার্নসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কথা বলাসংক্রান্ত কোর্স করার সুযোগ আছে। তিন থেকে সাত সপ্তাহের একেকটি কোর্স থেকে কীভাবে সুন্দর করে কথা বলা যায়, তা শিখে নিতে পারেন।